বিভ্রম

unt

আমরা রজব আলীকে এখনই গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে নামাবো এবং নামার সাথে সাথে সে প্রচণ্ড ধাক্কা খাবে। তাকে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ময়মনসিংহের তুলনায় ঢাকা শহরে শীত কম। অথচ বাস থেকে নেমে সে জমে যেতে শুরু করবে। তার মনে প্রশ্ন জাগবে তাকে কেনো মিথ্যে বলা হলো।

ময়মনসিংহ থেকে যাত্রী নিয়ে যাতায়াত পরিবহনের বাসটা এক ঘণ্টা দেরীতে ঢাকার গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে পৌছেছে। দেরীর কারণ ঘন কুয়াশা। ভোর হতে সামান্য দেরী, রজব আলী বাস থেকে নামতেই বরফ মেশানো ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত অন্ধ আক্রোশে তার শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে জমে যাচ্ছে, তবু কেনো মিথ্যে তথ্য দেওয়া হলো এ প্রশ্ন না তুলে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আক্কলের খাইছে মাডি/বাফে ফুতে কামলা খাডি।’

আশ্চর্য! রজব আলী কথা বলছে কেনো! ওর শুধু নিরবে জমে যাওয়ার এবং মনে প্রশ্ন জাগার কথা ছিলো। আপাতত বিষয়টা উপেক্ষা করা যাক, এখন রজবের শরীরে একটা সস্তা দামের খয়েরি রঙের শাল জড়িয়ে দেয়া যাক। শীতের বিরামহীন কামড় সহ্য করতে না পেরে রজব শালে মাথা আর কান ঢেকে নিবে। রজবকে বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া চায়ের টং দোকানে যাবে, পরপর দুই কাপ চা খাবে। সূর্য ওঠার অপেক্ষা করবে, কিন্তু কুয়াশা এবং আকাশ ভরা মেঘের কারণে আজ সূর্য উঠবে না।

রজব ঠকঠক করে কাঁপছে। শীতের হাওয়া শরীরে আছড়ে পড়ছে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষে হঠাৎ নামা প্রবল শীতের হাওয়ায় সে পাকা ধানের ঘ্রাণ পাচ্ছে। সে জানে এ অসম্ভব—ক্ষেতে ক্ষেতে ধান কাটা প্রায় শেষ, এ শহরে ধানের ঘ্রাণ নিষিদ্ধ না হলেও হাওয়ায় চেপে ঘ্রাণের শহর পর্যন্ত পৌছানো সম্ভব নয়। ঘ্রাণটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। খয়েরী রংয়ের সস্তা শালে কান আর মাথা মুড়ে সে চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়ায়। দুই কাপ চায়ে একটা বনরুটি ভিজিয়ে খায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় বুঝার চেষ্টা করে, কিন্তু সময় ধরতে পারে না। সে নিশ্চিত — কুয়াশার যে ভাবগতিক তাতে সূর্য উঠবে না। সে বিড়ি ধরায়, হাত মুঠ করে ছিলিমের মত টান দিয়ে বিরবির করে বলে, “বিড়ি-মাডি-ছাই/তিন গরিবের ভাই।”

রজবের যা করার কথা নয়, তাই করছে। শুধু ২কাপ চা খাওয়ার কথা সে বনরুটিও খেয়েছে। অপচয় ১০টাকা। শীতের হাওয়ায় বিপর্যস্ত হওয়ার কথা, সে পাকা ধানের ঘ্রাণ পাচ্ছে। সূর্য ওঠার জন্য অপেক্ষা করার কথা, সে ধরে নিয়েছে সূর্য উঠবে না। এবারও তার অবাধ্যতা উপেক্ষা করা যাক। এখন তাকে আবার বাসে তুলে দিবো, গন্তব্য বঙ্গ বাজার। ঝিমুতে ঝিমুতে গন্তব্যে পৌছবে। ওখানে অপেক্ষায় আছে দেশী ভাই হাফিজ। দু’জনে সাক্ষাৎ হবে, কুসুম কুসুম বিষাদে আক্রান্ত হবে এবং নাস্তা খাওয়া শেষে দু’জন মিলে দায়িত্বটা পালন করবে।

রজব নিজের ৪৭বছর বয়সী শরীরটাকে ক্রাচের ওপর ভর করে টানতে টানতে মূল সড়কে এনে দাঁড়ায়। বাসে উঠতে যাবে, হঠাৎ কি মনে হওয়ায় হাঁটতে শুরু করে। এ শহর দেড় দশকে অনেক বদলে গেছে, তবু বলাকা বাসের সাবেক হেল্পার রজব পথ চিনে চিনে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। রজব হাঁটছে, মাথার ভেতর ভাসছে সামাদ হাজীর কলোনি। নিচ তলায় ছোট বারান্দা শেষে একটা ঘর। বারান্দার ডান পাশের কোনে রান্না করছে রোকেয়া। মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা, ফর্সা ঘাড়, গরমে ব্লাউজ ভিজে গেছে। বারান্দার মাঝখানে খেলছে রুখসানা, ওদের প্রথম সন্তান। রজব চোখ বড়বড় করে মেয়েকে বললো, ‘পরের ঘরের পিডা, দাতে লাগে মিডা।’ কথা শেষ হবার আগেই খলখলিয়ে হেসে উঠলো মেয়েটা। বয়স মাত্র ৩ বছর, সব কথাতেই হাসে, চোখ বড় করে বকলে বেশী হাসে।

রজবকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হচ্ছে। ও অদ্ভূত আচরণ করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। বাসে ওঠার কথা, ওঠেনি। ঝিমানোর কথা, না ঝিমিয়ে স্মৃতি কচলাচ্ছে। স্মৃতি কচলানো খুব খারাপ অভ্যেস, একবার শুরু হলে চলতেই থাকে। এক স্মৃতির লেজ ধরে উপস্থিত হয় দশ স্মৃতি, দশটার লেজে লেজে জড়িয়ে থাকে আরও দশটা করে স্মৃতি। কচলানোর সময় নিজের সাথে দেখা হয়ে যায়, তারপর একশো রকম সুখের কথা হাজার রকম কান্নাকাটি। এখন রজবের মনে পড়বে মেয়েকে নিয়ে বাসে করে কতবার সায়েদাবাদ থেকে গাজীপুরে ঘুরতে গেছে। মনে পড়বে দুর্ঘটনায় পা হারানোর কথা, কঁচি হাত বুলিয়ে মেয়েটার বলা — ‘বাজান, তোমার ঠ্যাং কই? কাউয়ায় লয়া গেছে!’ মনে পড়বে অভাবের সংসারের ভাড় বইতে না পেরে মেয়েকে রেখে এক দুপুরে রোকেয়ার পালিয়ে যাওয়া। টিটি পাড়ার সংসার ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে গ্রামে ফেরা। মনে পড়বে শরীরটা আস্তে আস্তে অকেজো হওয়ায় সংসারের হাল ধরলো মেয়ে, ঢাকায় রুখসানা গার্মেন্টসে চাকরী নেওয়া। প্রতি মাসে বাবাকে টাকা পাঠানো, নতুন করে সংসার সাজানো শুরু হওয়া। অথচ রজবের এখন এসব ভাববার সময় নয়, ও শুধু ঝিমুবে, ঝিমুতে ঝিমুতে দেখা করবে হাফিজের সাথে। আমরা ওর পায়ে একটু ব্যথা তৈরী করে দেই, ওর বাসে ওঠা জরুরী।

রজব স্মৃতি কচলে হাঁটতে হাঁটতে মোহম্মদপুর পর্যন্ত চলে এসেছে। শহরের ব্যস্ততা এখনো শুরু হয়নি। ঢাকা শহর কি জাগবে না— প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ে রজবের মনে পড়ে আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির সাথে যোগ হওয়া শীতের প্রকোপে এ শহর আজ ঘুমে কাতর, যার জাগবার অনিবার্য বাধ্যবাধকতা নেই সে ছাড়া সবাই নিদ্রামগ্ন। রজবের বিড়ির নেশা পেয়েছে, ফুটপাতের এক পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরায় এবং বুঝতে পারে পিঠ ব্যথা করছে। ব্যথায় মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে। বিড়ি শেষ করে নিরুপায় হয়ে রজব বাসে ওঠে।

শেষ পর্যন্ত আমরা রজবকে বাসে তুলে দিতে পেরেছি। কিন্তু ওর পায়ে ব্যথা সৃষ্টি করেছি, ও ব্যথা বোধ করছে মাথা আর মেরুদণ্ডে। ওর মাথা ব্যথায় আপাতত আমাদের মাথা ব্যথা হবার কারণ নেই। এটা একদিকে ভালোই হয়েছে, অসুস্থ শরীরে ক্রাচে ভড় করে একটানা এতটা পথ হাঁটার ক্লান্তি এবং মাথা ব্যথার সম্মিলিত আঘাতে তার ঘুম পাবে। সে বাসে বসে ঘুমোক। দ্রুতই হাফিজের সাথে দেখা হবে, দুজনে মিলে কাজ শেষ করবে। কাজ শেষে হাফিজকেও ওর সাথে ময়মনসিংহে মানে গ্রামের বাড়িতে পাঠাবো, প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক মিনিটও এ শহরে ওদের অবস্থান করার সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না।

এই প্রথম রজব অবাধ্যতা না করে বাসের সিটে ঘুমিয়ে পড়লো। বাস বঙ্গবাজারে পৌঁছতে হেল্পার ওকে ডেকে তুললো, বাস থেকে নেমে মনে পড়লো পাঞ্জাবীর পকেটে মোবাইল সেট রয়েছে এবং সেটা বেজে যাচ্ছে। ফোনে যোগাযোগ করে হাফিজের সাথে দেখা হলো। দুই দেশী ভাই পরস্পরকে শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে রাখলো কিছুটা সময়।

রজব এবং হাফিজের কুসুম কুসুম বিষাদে আক্রান্ত হওয়ার কথা — কি আশ্চর্য, তা হয়নি। এই না হওয়াটা মেনে নেওয়া যায়, তাছাড়া স্মৃতি কচলানোর মত কুসুম কুসুম বিষাদও গাঢ় হয়ে ভয়াবহ আকার নিতে পারে। এখন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করিয়ে যে কোনো মূল্যে ওদের এ শহর থেকে বিদায় করতে হবে। বেশী ক্ষণ অবস্থানের সুযোগ দিলে এরা শহরের বাতাসকে দূষিত করে তুলবে।

রজব তার সকল অভাব মেনে নিয়েই পরম মমতায় রুখসানাকে বড় করেছে, নাজমাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে হাফিজ, দু’জন বাচ্চাদের মত হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে — পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া বস্তুগুলো সত্যিই তাদের প্রিয়তম সন্ততির দেহ! অভাবের তাড়নায় গার্মেন্টসে কাজ করতে এসে পুড়ে কুকড়ে যাওয়া প্রতিটি দেহকে মনে হচ্ছে নিজের মেয়ের লাশ, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে কোনোটাই তাদের মেয়ের লাশ নয়।

আমরা চেষ্টা করছি রজব আর হাফিজ যে কোনো দু’টা লাশ নিয়ে দ্রুত চলে যাক, দূষিত হবার হাত থেকে রক্ষা পাক শহরের মানবিক বাতাস। এমন নয় যে রুখসানা এবং নাজমার লাশ মূল্যবান, লাশপিছু ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সমান। তবু দুই বেকুব মিলে অযথা দেরী করিয়ে দিচ্ছে।

বিভ্রম | গল্প
৫ নভেম্বর ২০২১

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
বিভ্রম, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৫-০৫-২০২২ | ২২:২৯ |

    অসাধারণ একটি অণুগল্প উপহার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. নিতাই বাবু : ০৭-০৫-২০২২ | ১২:৪৫ |

    গল্পটা পড়তে খুবই ভালো লাগলো! লেখককে সাধুবাদ জানাই। 

    GD Star Rating
    loading...